https://www.facebook.com/Creativehira-health-care

আমাদের ফেসবুক পেজ ভিজিট করুন। নতুন নতুন তথ্য জানতে পেজটিতে লাইক দিয়ে আমাদের সাথে থাকুন।

This is default featured slide 1 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.

This is default featured slide 2 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.

This is default featured slide 3 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.

This is default featured slide 4 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.

This is default featured slide 5 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.

Monday, October 10, 2016

ছেলেবেলার গল্প

- ইমদাদুল হক মিলন

দশ এগারো বছর বয়সে বয়রা হয়ে গেলেন হাফেজমামা। কানে একদমই শোনেন না। তবু তাঁর দুরন্তপনায় বাড়ির লোক অতিষ্ঠ। মেজোনানা জাহাজের সারেঙ। বাড়িতে পুরুষ বলতে কেউ নেই। হাফেজমামাকে শাসন করার কেউ নেই। তিনি তাঁর মতো দুরন্তপনা চালিয়ে যাচ্ছেন। মেজোনানা বাড়ি এলেন। ছেলের লক্ষণ দেখে বিরক্ত। এসময় ফকির ফাকরা টাইপের কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করল, এই ছেলের মুসলমানি করানো যাবে না। মুসলমানি করালে ছেলের অনিষ্ট হবে। সে জানে বাঁচবে না। বয়রা কান নিয়েও কথাটা শুনতে পেলেন হাফেজমামা। ভিতরে ভিতরে রাগে ক্রোধে ফেটে পড়লেন। কিয়ের ঘোড়ার আণ্ডা অনিষ্ট হইব আমার? মোসলমানি না হইলে মাইনষে আমারে কইবো কী? আমি কি হিন্দু হইয়া থাকুমনি? কোত্থেকে গোপনে একটা ব্লেড জোগাড় করলেন। পায়খানা ঘরে ঢুকে সেই ব্লেড দিয়ে নিজের মুসলমানি নিজে করে ফেললেন। তখনকার দিনে হাফপ্যান্ট পরার রেওয়াজ ছিল না। বাচ্চা ছেলেরাও লুঙ্গি পরতো। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল হাফেজমামার লুঙ্গি। ওই অবস্থায় পায়খানা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। রক্ত মাখা লুঙ্গি দেখে হৈ চৈ পড়ে গেল বাড়িতে। কী হইছে? ও হাফেজ, কী হইছে? হাফেজমামা কথা বলেন না। মুখ চোখ কঠিন করে রেখেছেন। বাবা এবং সৎমা নানারকমভাবে প্রশ্ন করেন, হাফেজমামা কথা বলেন না। আমার বুজি হচ্ছে তাঁর সবচাইতে প্রিয় মানুষ। শেষ পর্যন্ত বুজি তাঁকে ধরলেন। কথা কছ না ক্যা? ও হাফেজ, কী হইছে? এত রক্ত কিয়ের? অহনও তো রক্ত পড়তাছে! বুজির কাছে গলা খুললেন হাফেজমামা। চাচী, নিজের মোসলমানি আমি নিজে কইরা হালাইছি। শুনে মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা বুজির। বললেন, কী করছস? মোসলমানি? নিজের মোসলমানি নিজে করছস? সব্বনাশ! তুই তো মইরা যাবি। বাড়িতে হাহাকার পড়ে গেল। মেজোনানা কান্নাকাটি শুরু করলেন। হায় হায় আমার এই পোলা তো আর বাচপো না! ফকিরে কইছিল মোসলমানি করাইলে অর অনিষ্ট হইব। সব জাইন্না বুইজ্জা এই কামডা ও কেমতে করল? কিন্তু হাফেজমামা নির্বিকার। নিজেই ত্যানা দিয়ে মুসলমানি করা জায়গাটা প্যাঁচিয়ে বেঁধেছে। অপরিসীম মনোবলের অধিকারী ছেলে। পাঁচ সাতদিনে দিব্যি সুস্থ। কিসের অনিষ্ট! কিছুই হলো না। নিজের মুসলমানির দিন হাফেজমামার ঘটনাটা আমার মনে পড়েছিল। আমাদের তিনভাইয়ের মধ্যে বাদলের মুসলমানি হয়েছিল আগে। তখন সে বেশ ছোট। পেশাব করতে অসুবিধা হতো। সংসার আলী হাজাম দেখে বুজিকে বলল, মোসলমানি করাইয়া দেন। ভাল হইয়া যাইব। এক বিকালে বাগানের দিকে একটা জলচৌকিতে বসিয়ে সংসার আলী হাজাম মোসলমানি করিয়ে দিল বাদলের। সমস্যাটা মিটে গেল। বাদলের মুসলমানিতে কোনো উৎসব আনন্দ হয়নি। হয়েছিল আমার আর আজাদের মুসলমানিতে। আজাদ তখন কাজির পাগলা হাইস্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। আমি পড়ি থ্রিতে। বিশাল আয়োজন হয়েছিল আমাদের মুসলমানিতে। ধুমধামের অন্ত নেই। সঙ্গে একটা দুর্ঘটনাও ঘটলো। দুপুরের পর পর ফিট হয়ে গেলেন বাবা। বুজি মা আর পুনুআম্মা ভাবলেন বাবা বোধহয় মারা গেছেন। আমরা মরা কান্না জুুুুড়ে দিলাম। মুসলমানির উৎসব আনন্দ ভুলে আমি ছটফট করছি আর কাঁদছি। চিৎকার করে কাঁদছি। বাবার কাছে যেতে চাইছি, লোকজনের ভিড়ে যেতে পারছি না। বাবাকে আমি কী যে ভালবাসতাম! কী যে টান বাবার জন্য আমার ছিল! বাবার মুখটা একপলক দেখার জন্য পাগল হয়ে থাকতাম। বাবার গলার আওয়াজ পেলে বুক ভরে যেত গভীর আনন্দে। বাবাকে আমরা বাবা ডাকতাম না। ডাকতাম আব্বা। আব্বা ডাকার পিছনে একটা ঘটনা আছে। তখন আমরা তিনটি মাত্র ভাইবোন জন্মেছি। আজাদ মণি আর আমি। আমার হয়তো এক দেড়বছর বয়স। মণির তিন সাড়েতিন। আজাদ পাঁচের ওপর। জিন্দাবাহার থার্ডলেনে থাকি। বাবা চাকরি করেন মিউনিসিপ্যালিটিতে। ছুটির দিনে বড়ছেলের হাত ধরে কোনো এক কলিগের বাসায় গেছেন। সেই বাসার ছেলেমেয়েরা বাবাকে আব্বা ডাকে। আব্বা ডাকটা বোধহয় তখনকার জন্য আধুনিক। বাসায় ফিরে মাকে বাবা বললেন, তোমার ছেলেমেয়েদেরকে আব্বা ডাক শিখাও। এখন বাবাকে সবাই আব্বা ডাকে। মা আমাদেরকে বাবার পরিবর্তে আব্বা ডাকতে শিখালেন। চার পাঁচ বছর বয়সেই আমি নির্বাসনে চলে এলাম মেদিনীমণ্ডল গ্রামে। নানীর কাছে। নানীকে ডাকি বুজি। আজাদ আমি, কখনো কখনো মণিও এসে থাকতো বুজির কাছে। কিন্তু আমার মন পড়ে থাকতো আব্বার কাছে। মার কথা মনেই পড়তো না। মেদিনীমণ্ডলের একেকটা নির্জন দুপুরে নানাবাড়ির বাগানের দিকটায় তাকিয়ে আমার খুব আব্বার কথা মনে পড়তো। ছোটখাটো রোগা ধরনের মানুষ। মুখটা কী সুন্দর। গলার আওয়াজ মধুমাখা। মাথায় হাত বুলিয়ে কাছে টানলে মনে হতো এরচে’ বড় আনন্দ জীবনে আর কিছু হতে পারে না। সুন্দর একটা গন্ধ ছিল আব্বার গায়ে। তখনকার ঈদগুলো হতো শীতকালে। আমরা তখন সাতটি ভাইবোন। আমার পর বাদল আর পলি যমজ। ওরা জন্মে ছিল জিন্দাবাহারের বাসায়। সেবার খুব বন্যা হয়েছিল। জিন্দাবাহারের ওই গলির ভিতর পানি ঢুকে গিয়েছিল। বাড়ির নাম্বার সাত। থার্ডলেন। টইটম্বুর পানিতে মাচা বেঁধে থাকতে হয়েছিল। ওই অবস্থায় যমজ ছেলেমেয়ের বাবা হলেন আব্বা। ওই বাসায় আর একটা মাত্র ভাই হয়েছিল আমাদের। উষার পর। সেই ভাইটিকে আমি দেখিনি। আঠারো দিন বয়সে মারা যায়। সবার ছোট আসমা জন্মেছিল গেণ্ডারিয়ায়। গেণ্ডারিয়ার ডিস্টিলারি রোডের পশ্চিম দিকটায়, ধোলাই খালের কাছাকাছি একটা জায়গার নাম মুরগিটোলা। মুরগিটোলায় আফতাব মিয়া নামের এক ঢাকাইয়া ভদ্রলোকের আড়াই তিনকাঠার ওপর একতলা বাড়িতে আমরা তখন থাকি। ততোদিনে আমার ঢাকার জীবন শুরু হয়ে গেছে। অঘ্রাণ পৌষমাসের তীব্র শীতে তখন ঈদ হতো। ঈদের সময় ফ্যামিলি নিয়ে গ্রামে আসতেন বাবা। দুইছেলে পড়ে আছে গ্রামে। তাদেরকে নিয়ে, বুজি এবং পুনুআম্মাকে নিয়ে ঈদ করবেন। কেরানীর চাকরি করেন মিউনিসিপ্যালিটিতে। রুজি রোজগার ভালো। টাকা পয়সা খরচা করতেন অকাতরে। সদরঘাট থেকে মুন্সিগঞ্জ হয়ে, কখনো চাঁদপুর হয়ে, মেঘনা পদ্মা পাড়ি দিয়ে লঞ্চ যায় লৌহজং মাওয়া তারপর ভাগ্যকূল। অমুক তারিখে বাড়ি আসবেন, চিঠি লিখে জানিয়েছেন আব্বা। তাঁর হাতের লেখা ছিল মুক্তার মতো। মাওয়ার ওদিককার সেহের আলী পিয়ন চিঠি দিয়ে গেছে বাড়িতে। ইনভেলাপের চিঠি না। পোস্টকার্ড। পুনুআম্মা শব্দ করে সেই চিঠি পড়ছেন, বুজি আমি আর আজাদ গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনছি। তারপর শুরু হতো দিনগোনা। কবে আসবে সেই দিন? কবে? কবে হাজামবাড়ির ছেলেদের নিয়ে আমরা দুটিভাই গিয়ে দাঁড়াবো নদীরঘাটে। বিকেল ফুরিয়ে আসা আলোয় লৌহজংয়ের ওদিক থেকে প্রথমে দেখতে পাবো লঞ্চের ধোঁয়া, তারপর আস্তে ধীরে ভেসে উঠবে একটা লঞ্চ। ভটভট শব্দ করে এগিয়ে আসতে থাকবে মাওয়ার দিকে। লঞ্চ দেখেই নদীর পাড় ধরে দৌড়াতে থাকবো আমি। যেন যতদূর এগিয়ে যেতে পারি। যেন যত আগে আব্বাকে দেখতে পাই আমার কোনো বোনের হাত ধরে লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে মোহন হাসি। হাজামবাড়ির ছেলেরা ব্যাগ সুটকেস বহন করে আনতো। ছোটবোনগুলোর কেউ কেউ হাঁটতে পারতো না। মাওয়া তখন মেদিনীমণ্ডল থেকে অনেক দূরে। এক দেড়মাইল তো হবেই। এতটা পথ ছোট বাচ্চারা হাঁটবে কেমন করে! কাউকে কাউকে কোলে করে আনতে হতো। আব্বা বাড়ি এলে কী যে উৎসব শুরু হতো! ঈদের আগের সন্ধ্যায়ই যেন ঈদ শুরু হয়ে যেত। হয়তো খানিক আগে বারবাড়ির ওদিকটায় দাঁড়িয়ে, বিলের বাড়ির শিমুলগাছটির মাথার ওপর মিষ্টি কুমড়ার ফালির মতো চাঁদটা একটুখানি দেখা গেছে, তারপরই যেন শুরু হয়ে গেছে ঈদ। কোনো কোনো বছর শীতের বিকেলে বিলের দিকে জমে ওঠা কুয়াশায় চাঁদ দেখা যেত না। দেশ গ্রামের মানুষ পড়ে যেত ধন্দে। কাল কি ঈদ হবে? সে বছর আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য স্পঞ্জের স্যান্ডেল কিনে নিয়ে গেছেন আব্বা। আর কেরোলিনের হাফশার্ট। স্পঞ্জের স্যান্ডেল আর কেরোলিনের শার্ট তখন বিরাট ফ্যাশান। সঙ্গে আছে ইংলিশ প্যান্ট। আমার শার্টটা ছিল হালকা আকাশি রংয়ের। আজাদেরটা হালকা সবুজ। আগের রাতে উত্তেজনায় আমার ঘুম আসে না। কখন, কখন সকাল হবে, কখন গোসল করে স্পঞ্জের স্যান্ডেল আর কেরোলিনের শার্ট পরবো। কুয়াশার জন্য চাঁদ দেখা যায়নি। তাতে কি? ঈদ তো কাল হবেই। গ্রামে তখন রেডিও নেই। ঈদের খবর শোনার কোনো উপায় নেই। ঊনত্রিশ রোজার পরই ঈদ হবে, নাকি রোজা হবে পুরা ত্রিশটা কে জানে! ‘খাইগ’ বাড়ির মাঠে প্রতিবছরের মতো ঈদের জামাত হবে এটা তো সবাই জানে। আনন্দ উত্তেজনায় ‘বিয়াইন্না রাইতেই’ উঠে গেছি আমরা। বাইরে তখনো আলো ফোটেনি। কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে দেশগ্রাম। মা আম্মা আর বুজি কুপি হাতে চলে গেছেন ‘রান্ধন’ ঘরে। ক্ষির সেউই রাঁধতে বসবেন। রান্নাবান্নায় তাদেরকে সাহায্য করতে হাজামবাড়ি থেকে আসবে অজুফা। পারু নামে একটা যুবতী মেয়ে আছে বাড়িতে। কোন দিককার দূরসম্পর্কের আত্মীয় পারু আমি জানি না। সে থাকতো আমাদের বাড়িতে। কাজের মেয়ে হিসাবেই থাকতো। আমরা ‘কেফিনে’ বসে, বারান্দা কিংবা ‘খাটালে’ বসে অপেক্ষা করছি কখন আলো ফুটবে, কখন ঘর থেকে বেরুবো। পুকুরঘাটে গিয়ে এই শীতে গোসল করবো। তারপর নতুন জামাকাপড় পরে ঈদ শুরু করে দেবো। ‘বম’ ফুটাবো। ‘বম’ মানে পটকা। লাল নীল নানা বর্ণের কাগজে জড়ানো গোল একটা জিনিস। কবুতরের ডিম সাইজের। মাওয়া কিংবা কাজির পাগলা বাজার থেকে কিনে আনা হয়েছে। আজাদ হচ্ছে এসবের ওস্তাদ। ছানা সেন্টুর সঙ্গে গিয়ে দুতিনদিন আগেই কিনে এনে রেখেছে। মাটিতে জোরে আছাড় মারলেই ফটাস করে শব্দ হয়। মোমবাতি সাইজের একরকম ‘বম’ও আছে। মুখের কাছে একটা ‘সলতা’। ম্যাচের কাঠি জ্বেলে সলতায় আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে মারতে হয়। বোমার মতো শব্দ হবে। বিয়েবাড়ি ঈদ মুসলমানির উৎসবে খুব ‘বম ফুটানো’ হতো তখন। আমি ছেলেবেলা থেকেই ভিতু টাইপের। মাটিতে আছড়ে মারা বম দুয়েকবার ফুটিয়েছি। কিন্তু ওই আগুন দিয়ে ধরানোটা কখনও ফুটাইনি। কেউ ফুটাচ্ছে দেখলেই ভয়ে মুখ শুকিয়ে যেত। দুকানে আঙুল দিতাম। তখন হয়তো একটু একটু করে আলো ফুটছে। গাঢ় হয়ে জমে থাকা ‘খুয়া’ কাটতে শুরু করেছে। বাগানের দিকে ডাকাডাকি করছে কাউয়া শালিক, দইকুলি। হামিদমামা ননীমামারা বমটম ফুটাচ্ছে। হাজামবাড়ির ছেলেরা অনেকেই এসে পড়েছে। আইজ্জাদাও আছে তাদের সঙ্গে। ঈদ শুরু হয়ে গেছে। আমরা লাফাতে লাফাতে ঘর থেকে বেরুলাম। হৈ চৈ বম ফুটাফুটি। কেউ কেউ গামছা বদনা হাতে চলে যাচ্ছে পুকুরঘাটে। পৌষ মাঘমাস। আর তখনকার দিনে শীতও পড়তো। দেশগ্রামের লোকে বলতো, ‘মাঘের শীত বাঘের গায়।’ তার মানে মাঘ মাসের শীতে বাঘও কাবু হয়ে যায়। সেই শীত আমরা তোয়াক্কা করছি না। পুকুরঘাটে চলে যাচ্ছি। বড় পুকুরটা ভরা থাকতো কচুরিতে। লম্বা লম্বা, ঠাসা কচুরি। বেগুনী ফুলে চমৎকার দেখাতো। প্রত্যেক শরিকের নিজের সীমানায় একটা করে ঘাট। অল্প একটু জায়গার কচুরি সরিয়ে পুকুরের ভিতর দিকে চার পাঁচহাত পর্যন্ত হাত দেড়েক চওড়া একটা তক্তা ফেলা। আসলে একটা অসমাপ্ত সাঁকো। ওই ঘাটে বসে পুকুর থেকে লোটা বদনা ভরে পানি তুলে তুলে গোসল করা। আল্লাহ রে! পানি যা ঠাণ্ডা। পানির রং কাউয়ার চোখের মতন। তার ওপর ধোঁয়ার মতো ভাসছে কুয়াশা। প্রথম বদনা ঢালবার আগেই হি হি করে কাঁপতো সবাই। কোনো রকমে এক বদনা ঢেলে ফেলার পর একটু সয়ে আসতো শীত। তারপর তিনচার বদনা ঢেলে গোসল শেষ। নতুন জামাকাপড় পরার উত্তেজনায় বাঘের শীতও তোয়াক্কা করছি না। হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে কোনো রকমে শরীর মোছা। মুছিয়ে দিচ্ছেন পুনুআম্মা। আমার সমস্ত তদারকি তাঁর। মা আমাকে কখনো ধরেও দেখেন না। মায়ের আদর সব পাই আমি পুনুআম্মার কাছে। তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ধপধপে সাদা ইংলিশ প্যান্ট, আকাশি রংয়ের কেরোলিনের শার্ট, পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। মুহূর্তে রাজপুত্র হয়ে গেলাম আমি। কিন্তু আব্বাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। গনিমামাও সেবার বাড়িতে। গনিমামা হামিদমামা ননীমামা, গেল কোথায় সবাই! নামাজের সময় হয়ে এলো। ক্ষির সেউই খেয়ে খাইগ বাড়ির মাঠে যাব ঈদের নামাজ পড়তে। তারপর বাড়ি ফিরে এবাড়ি ওবাড়ি যাব। দুপুরবেলা মুরগির গোস, পোলাও খাবো। ক্ষির সেউইয়ের ওপর দিয়ে রাখা কিসমিস বেছে বেছে খাব। আগের রাতে মুঠো মুঠো কিসমিস চিনেমাটির গামলা আকৃতির পেয়ালায় ভিজিয়ে রেখেছেন বুজি। খুরমাগুলো চিউলি চিউলি করে কেটে ভিজিয়ে রেখেছেন। ক্ষির সেউইর ওপর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সেই মহার্ঘ্য বস্তু। খেতে যে কী মজা! আব্বাকে খুঁজতে আমিনুল মামাদের বাড়ির ওদিকটায় গেছি। বাড়ির পুবদিককার নামায় মিয়াদের সেই দুটো হিজলগাছ শীতে জবুথবু হয়ে আছে। দূরে হালটের লাগোয়া জাহিদ খাঁর সীমানায় দাঁড়ানো হিজলগাছটার তলায় দেখি বেশ একটা জটলা। আব্বাও আছেন সেখানে। কী কী বিষয়ে খুব কথাবার্তা তর্ক বিতর্ক চলছে। জাহিদ খাঁর ছেলেরা, মতলেব মামা মাতাব আলী মোতাহারদা ওহাবদা, লতিফখাঁ আমিন মুন্সি সাহেব। গনিমামা হামিদমামারাও আছেন। হাজামবাড়ির আবদুলদাকেও দেখলাম। একসময় আমাদের বাড়ির দলটা ফিরে এলো আব্বার সঙ্গে। আমাকে দেখে আব্বা বললেন, আইজ ঈদ হইব না বাজান। ঈদ হইব কাইল। আমি বিষণœ মুখে বাড়ি ফিরে এলাম। মুহূর্তে সারাবাড়ি জেনে গেল আজ ঈদ হচ্ছে না। কারণ গতকাল চাঁদ দেখা যায়নি। কেরোলিনের শার্ট, সাদা হাফপ্যান্ট আর স্পঞ্জের স্যান্ডেল মন খারাপ করে খুলে রাখি আমি। কাল আবার পরবো। কিন্তু আজ পরে ফেলেছি, ঈদের জামা পুরনো হয়ে গেল। এই মনোকষ্টে সারাদিন বিষণœ হয়ে থাকি। ঈদের দুতিনদিন পর স্ত্রী কন্যাদেরকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন আব্বা। নাকি মণিকেও রেখে গেলেন সেবার! আর রেখে গেলেন বাদলকে। জন্ম থেকেই বাদল খুব রোগা। পেটের অসুখ লেগেই আছে। বুজি খুব আদর করেন বাদলকে। বাদলকে তিনি রেখে দিলেন। মা একলা এতগুলো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে কেমন করে সামলাবেন! বিক্রমপুরের ভাষায় ছোট ছেলেমেয়েকে বলে ‘এন্দা গেন্দা’। এন্দা গেন্দার দল নিয়ে মা আর আব্বা চলে যাচ্ছেন ঢাকায়। যাওয়ার পথটা ভিন্ন। মাওয়া হয়ে যাওয়ার ঝামেলা অনেক। গোয়ালন্দ থেকে ভাগ্যকূল হয়ে লঞ্চ আসে দুপুরের পর। সেই লঞ্চে চড়লে ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে গভীর রাত। অতরাত্রে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে জিন্দাবাহার যাওয়া মুশকিল। যদিও সদরঘাট থেকে খুবই কাছে জিন্দাবাহার। পাটুয়াটুলির দক্ষিণ মুখ দিয়ে ঢুকে হাতের বাঁদিকে নোয়াববাড়ি। নোয়াববাড়ির মাঠের ভিতর দিয়ে বেশ কাছে জিন্দাবাহার থার্ডলেন। আটানা দশআনায় ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া যায়। অতরাত্রে ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া মুশকিল। এজন্য অন্যপথে রওনা দিতেন আব্বা। তখনকার দিনে শীতকালেও তালুকদার বাড়ির খাল, মানে সীতারামপুরের খাল ভরা পানি। বেলদাররা কেরায়া নৌকা বাইতো। হাজামবাড়ির মজিদ গিয়ে আগের সন্ধ্যায় নৌকা ঠিক করে রেখেছে। কোনো কোনো বছর হযরতদের বাড়ির লাগোয়া খালের বাঁশ কাঠের নড়বড়ে পুলটার তলায় এসেও ভোরের আলো ফুটে উঠবার আগ থেকেই নৌকা নিয়ে বসে থাকতো বেলদার মাঝি। বাড়ি থেকে চট করেই সেখানে গিয়ে নৌকায় উঠতো সবাই। ওদিকটায় পানি কম থাকলে যেতে হতো তালুকদার বাড়ির ঘাটে। সীতারামপুরের খালে। ওখান থেকে কাজির পাগলা বাজার ডানহাতে রেখে নৌকা চলে যেত গোয়ালিমান্দ্রা হলদিয়ার খালে। ডানহাতে বেশ কিছুটা দূরে গোয়ালিমান্দ্রার হাট রেখে উত্তর দিকে চলতে থাকতো। উত্তর দিকে শ্রীনগর। শ্রীনগরের ঘাটে ভিড়ে থাকতো ঢাকার লঞ্চ। সেই লঞ্চে সকাল দশটা এগারোটার দিকে চড়লে বিকাল তিনটা চারটায় সৈয়দপুর ফতুল্লা হয়ে ঢাকা। কত সুন্দর সুন্দর নামের জায়গায় যে ভিড়তো লঞ্চ। যাত্রী তুলতো, যাত্রী নামাতো। ষোলঘর, আলমপুর, রাজানগর, শেখরনগর। কুচিয়ামোড়া নামে একটা ঘাট ছিল। লোকে বলতো ‘কুইচ্চামারা’। ‘কুইচ্চা’ জিনিসটা হচ্ছে বাইন মাছের মতো একটা জীব। গাঢ় খয়েরি রংয়ের। তেলতেলে। বহুদিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল জায়গাটার নাম ‘কুইচ্চামারা’ হয়েছে বোধহয় ওই জীবটির নাম থেকে। এই এলাকায় বোধহয় ‘কুইচ্চা’ জন্মায় অকাতরে। লোকে সেগুলো বেধড়ক মারে বলে নাম হয়েছে ‘কুইচ্চামারা’। ওই ঘাট থেকে লঞ্চের ডেকে উঠতো শুধু দুধ। এলাকাটা ঘোষদের। লোহার চকচকে বিশাল পাত্র ভরা দুধ লঞ্চে তুলতো দুজন করে লোক। লোহার পাত্রটার দুদিকে শক্ত হ্যান্ডেল। দুজন দুদিক থেকে ধরে সেই দুধভর্তি ওজনদার পাত্র তুলতো। দুধের মধ্যে ফেলে রাখা হতো ছোবড়া ছাড়া কচুরি। কেন যে কচুরি ফেলে রাখা হতো কাঁচা দুধে, সেই রহস্য আমার কোনোদিন জানা হয়নি। ওই ঘাট থেকে প্রচুর ছানাও তোলা হতো লঞ্চে। ছানা গিঁট দিয়ে বাঁধা থাকত ধোয়া কিংবা নতুন গামছায়। চার পাঁচসের করে ছানা হবে একেকটা গামছায়। পার থেকে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ছানার বোঝা নিয়ে লঞ্চে উঠতো, খালি গায়ের, লুঙ্গি কাছামারা কিছু লোক। থকথকে গামছা বাঁধা ছানা ধপ ধপ করে ফেলতো লঞ্চের ডেকে। ঢাকা পর্যন্ত দুধ ছানার কাঁচা গন্ধে ম ম করতো লঞ্চের ডেক। ফতুল্লার আগে ছিল একটা ইটখোলা। দূর থেকে ইটখোলার চিমনি দেখে বুঝে যেতাম, এই তো ঢাকায় এসে পড়েছি। ফতুল্লা মানেই তো ঢাকা। ফতুল্লা থেকে ঢাকায় আসতে তখন ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। সেই একটা ঘণ্টা আর কাটতে চাইতো না। চলে যাওয়ার দিন আব্বা আমাকে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে খুব আদর করতেন। গোপনে একআনা দুআনা পয়সা দিতেন। আব্বার সঙ্গে সীতারামপুর ঘাট পর্যন্ত যেতাম। নৌকা ছেড়ে দিতো। মা বোনদের জন্য না, আমার মন খারাপ হতো আব্বার জন্য। নৌকার পিছন দিককার গলুইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আব্বা তাকিয়ে আছেন আমার দিকে, খালপাড়ে দাঁড়ানো আমি তাকিয়ে আছি আব্বার দিকে। আব্বার চোখ ছলছল করছে, আর আমি নিঃশব্দে চোখ মুছছি। মা আছেন নৌকায়। তাঁর কোলে হয়তো তখন পর্যন্ত সবার ছোট সন্তানটি। তিনি কোলের সন্তান নিয়ে ব্যস্ত। আমার দিকে তাকাবার সময়ই নেই। আমিও তাকাচ্ছি না মায়ের দিকে। তারপর থেকে সবকিছু ফাঁকা। বুজি পুনুআম্মা আজাদ মণি বাদল এতগুলো মানুষ বাড়িতে। বাঁধা কামলা আছে আলফু, কাজের মেয়ে আছে পারু, ফতির মাও আছে। তারপও আমি যেন একা। সম্পূর্ণ একা। হাজামবাড়ির পুকুরটায় তেমন মাছ ছিল না। তারপরও ফাল্গুন চৈত্রমাসে ঘটা করে একদিন ঝাঁকিজাল পলো নিয়ে নামা হতো পুকুর। বেজায় মাছ ধরার নেশা ছিল আজাদের। তখনও সে ছোট। পলো ‘চাবাতে’ পারে না। সংসারে উপযুক্ত বয়সের পুরুষমানুষ মানে আলফু। আলফু অতি সরল, নির্বোধ টাইপের। তার গলার আওয়াজ আমি কোনোদিন শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তবে তামাক খেত প্রচুর। লুঙ্গি সব সময় কাছা মারা। শার্ট গেঞ্জি কোনোদিন পরতে দেখিনি। ‘নিমা’ নামের ফতুয়ার মতো নীল রংয়ের একটা জিনিস ছিল তার। দেশে, অর্থাৎ চরে যাওয়ার দিন সেটা সে পরত। কাঁধে লুঙ্গি দিয়ে বাঁধা ‘গাট্টি’। মাছ টাছ তেমন ধরতে পারতো না। ক্ষেতখোলা আর বাড়ির কাজ করতো। হাজামবাড়ির পুকুরে সেবার মাছ ধরা হচ্ছে। দুপুরের দিকে জাল পলো নিয়ে নেমেছে লোকে। বড় ক্ষেতের কাজ সেরে এসে রান্ধনঘরের ‘ছেমায়’ বসে তামাক খাচ্ছে আলফু। রান্ধনঘর থেকে বুজি ডাকল, ও আলফু। তামাক খেতে খেতে সাড়া দিল আলফু। উঁ। আজাম বাড়ির পুকঐরে যাও। ক্যা? বাইত্তে মাছ নাই। পলো লইয়া যাও। চাবাইয়া দেহ কিছু পাওনি। আইচ্ছা। গভীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুরনো পলোটা হাতে নিয়ে আমিনুল মামাদের বাড়ির ওপর দিয়ে হাঁটা দিল আলফু। আমি গেলাম তার পিছু পিছু। অতিশয় বিরক্ত মুখে পুকুরে নামলো আলফু। পলো চাবাতে লাগল। ভঙ্গিটা এমন, যেন মালিক বলেছে বলে কাজটা করছে। মাছ পাওয়া না পাওয়ায় কিছু যায় আসে না। মিয়াদের জোড়া হিজলতলায় দাঁড়িয়ে লোকজনের মাছ ধরা দেখছি আমি। আশ্চর্য ব্যাপার, কেউ তেমন কিছু পেলো না, আলফু একটা মাঝারি সাইজের বোয়াল মাছ পেলো। দুই সোয়া দুইহাত লম্বা। বেশ মোটাতাজা বোয়াল। কিন্তু বিল পুকুরের বোয়ালের রং না মাছটার। বিল পুকুরের বোয়াল হয় হলুদ, এই মাছটা ধপধপে সাদা। বাড়ি নিয়ে আসার পর মাছ নিয়ে নানা রকমের গুঞ্জন শুরু হলো। এটা কি আসল বোয়াল মাছ নাকি বোয়াল মাছের রূপে অন্যকিছু। নানাবাড়ির বড় পুকুরটায় বিশাল বিশাল গজার মাছ ছিল। সেইসব গজার মাছ নিয়ে নানা ধরনের ভৌতিক গল্প ছিল। এক ধরনের গজার মাছ আছে যাদের কপালে নাকি সিঁদুরের ফোঁটা থাকে। সেগুলো নাকি মাছ না, মাছের রূপে ‘শকশো’। ওরকম গজার মাছ ভুলিয়ে ভালিয়ে মানুষকে পানিতে নামায়। মাছ ধরবার প্ররোচনা দেয়। তারপর পানিতে ডুবিয়ে মারে। আলফুর ধরা বোয়াল মাছটাও তেমন কিছু কি না কে জানে। বুজি বলল, আলফু, এই মাছ হালাইয়া দেও। এই মাছ আমরা খামু না। আলফু বলল, আপনেরা কেউ না খাইলে আমি খামুনে। না না তোমার খাওনও ঠিক হইব না। ঠিক হইব আম্মা। কোনো অসুবিদা হইব না। আমরা গাঙপারের মানুষ। সাদা বোয়াল বহুত দেখছি, বহুত খাইছি। গাঙ্গের বোয়াল সাদা হয়। এইডা হইল গাঙ্গের বোয়াল। বাইষ্যাকালে গাঙ্গের পানির লগে গেরামে ঢুইক্কা গেছে। হাজামবাড়ির পুকুঐরে আটকা পড়ছিল। আলফুর কথা পাত্তা দিলেন না বুজি। বললেন, না না এই মাছ খাওন ঠিক হইব না। কইলাম তো আপনেরা খাইয়েন না। আমি খামুনে। খাইলে খাও গিয়া। তয় মাছটা কোডবো কে? রানবো কে? আমি নিজেই কুডুমনে, নিজেই রান্ধুমনে। যা ইচ্ছা করো গা। বাগানে বসে সেই মাছ নিজে কুটলো আলফু, নিজে রান্না করলো, আমরা অতি উৎসাহ নিয়ে দেখলাম। আট দশদিন ধরে সেই মাছ গরম করে আলফু আর খায়। মাছের স্বাদ নাকি অসাধারণ। তারপর পাঁচ সাতদিনের জন্য দেশে গেল আলফু। আমাদের বড় ক্ষেতটা তখন চষা হচ্ছে। তারেক নামে একটা লোক আছে, হুমাদের বাড়ির পুবের ভিটায় ঘর। লোকে ডাকে তারিক্কা। একজোড়া হালের বলদ আছে তার, লাঙল আছে। রোজ দরে অন্যের জমি চষে দেয়। আমাদের ক্ষেত চাষ দিতে নেমে গেছে। চাষ দেয়া হলে মাটির বড় বড় চাকাগুলো শুকিয়ে পাথরের মতো হবে। ইটামুগুর দিয়ে সেই চাকা ভেঙে গুঁড়িয়ে তারপর ছড়াতে হবে ধান। ততোদিনে বৃৃষ্টি বাদলা শুরু হবে। বৃষ্টির পানি পেয়ে ধানচারা বেরুতে থাকবে মাটি ফুঁড়ে। বুজিকে আলফু বলে গেল, পাঁচ সাতদিন পর ফিরে এসে ইটামুগুর নিয়ে ক্ষেতে নামবে। যথাসময়ে সব কাজ শেষ করবে। পাঁচদিন গেল, দশদিন গেল। পনেরো দিন গেল, আলফু আর আসে না। আমাদের চষা ক্ষেত বড় বড় মাটির চাকা বুকে নিয়ে ফাল্গুন চৈত্রমাসের তীব্র রোদে উজবুকের মতো পড়ে আছে। আলফুর অপেক্ষায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। বুজি আর পুনুআম্মা সারাক্ষণ আলফুর চিন্তায় অস্থির। এবার কি ধানটা তাহলে বোনাই হবে না? নাকি অন্যলোক জোগাড় করে কাজ শুরু করে দেবে? আলফু ফিরে এলো একুশ দিন পর। চেহারা সুরত একদম অন্যরকম। মুখটা শুকিয়ে এই এতটুক হয়ে গেছে। চোখ দুটো ইঞ্চিখানেক গর্তে। দৃষ্টি একেবারেই নির্বিকার। পাঁচটা কথা জিজ্ঞেস করলে হুঁ হাঁ করে একটার জবাব দেয়। বহু চেষ্টায় জানা গেল বাড়ি যাওয়ার পর তার খুব জ্বর হয়েছিল। জ্বরে ভুগে এই দশা। এজন্য এতদিন আসতে পারেনি। কথাবার্তা যেটুকু বলে তাতে কেমন একটা উ™£ান্ত ভাব। নাওয়া খাওয়ায় মন নেই। বারান্দায় শুয়ে সারারাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রাতে বোধহয় ঘুমায় না। বুজি আর পুনুআম্মা আলফুকে নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে গেলেন। পরদিন থেকে ইটামুগুর নিয়ে ক্ষেতে নামলো আলফু। বুজি আর পুনুআম্মাকে দেখি বড়ঘরের পশ্চিম কোনার ফজলি আমগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে বড়ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে আলফুকে দেখেন। পাঁচ সাত মিনিট কাজ করেই ক্ষেতের মাটিতে লেছড়ে পেছড়ে বসে পড়ে আলফু। ইটামুগুর ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশের দিকে হাত তুলে কী কী যেন বলে। দিনে দিনে অস্বাভাবিক হতে লাগল লোকটা। খায় না, গোসল করে না। থম ধরে বসে থাকে। তার অতিপ্রিয় তামাকে আগের মতো মন নেই। আগে সারারাত ফোস ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো, এখন কদিন ধরে রাতভর করুণ মিহি সুরে গুণ গুণ করে কাঁদে। বুজি আর পুনুআম্মা কোনো কোনো রাতে উঠে জিজ্ঞেস করে, ও আলফু, কী হইছে? কান্দো ক্যান? আলফু কথা বলে না। তারপর আলফু একদিন উধাও হয়ে গেল। তার লুঙ্গি নিমা সব পড়ে আছে বারান্দায়, আলফু নেই। নেই তো নেইই। কোথায় উধাও হয়ে গেছে কে জানে। সারাগ্রাম তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো আলফুকে। মইজ্জাদা আইজ্জাদা, রব হাইপ্পা এমনকি পারু আর ফতির মা পর্যন্ত এবাড়ি ওবাড়ি খুঁজল। না আলফু কোথাও নেই। একদিন গেল। দুদিন গেল। দিন যেতে লাগল, আলফু আর ফিরল না। তার চরের বাড়িতে খবর পাঠানো হলো। না, আলফু সেখানেও যায়নি। বুজি বলাবলি শুরু করলো, এইডা ওই সাদা বোয়াল মাছ খাওনের ফল। ওইডা তো মাছ আছিলো না। ওইডা আছিলো ‘শকশো’। আমি না করছি, তাও আলফু শকশো খাইছে। শকশো তো খাওন যায় না, তারা হইতাছে নিরাকার। বোয়াল মাছের রূপ ধইরা আলফুরে ভুলাইছে। আমরা দেখছি আলফু ওই মাছ খাইতাছে। আলফুও খাওনের সময় মাছের স্বাদ পাইছে। আসলে ভুল, সবই ভুল। ও শকশো খাইবো কী, শকশোতেই অরে খাইছে। কোন বিল বাউরে নিয়া মাইরা কেদা পানির ভিতরে গুইজ্জা রাখছে কে জানে! সত্যি সত্যি এই জীবনে আলফুর আর কোনো হদিশ আমরা পাইনি। কোন রহস্যে উধাও হয়ে গিয়েছিল, কে জানে।